Monday, April 6, 2009

ইমন জুবায়ের ; একটি হত্যাকান্ডের পটভূমি

ইমন জুবায়ের

একটি হত্যাকান্ডের পটভূমি


এই আধুনিক সময়েও মধ্যযুগীয় পুরনো শাস্ত্র আর তার রচয়িতাদের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না; বললে- মৃত্যু অনিবার্য। তেমনি একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল ২০০৪ সালে। হল্যান্ডে। মরক্কোর এক ধর্মান্ধ জঙ্গি নির্মম ভাবে খুন করে বসল নেদারল্যান্ডের একজন মুক্তমনা চলচ্চিত্র নির্মাতাকে। আবারও প্রকাশ পেল ধর্মান্ধতার বিভৎস রুপ। চমকে উঠল সমগ্র পশ্চিমাবিশ্ব। সমগ্র পশ্চিমাবিশ্ব আবারও পরম অবিশ্বাসের চোখে মুসলিমবিশ্বের দিকে তাকাল- যা ভবিষ্যৎ সর্ম্পকের ক্ষেত্রে শুভ পরিনতি বয়ে আনবে না বলেই মনে হল ...

সোমালিয় নারী আইয়ান হিরসি আলীর জন্ম ১৩ নভেম্বর ১৯৬৯ সালে সোমালিয়ার রাজধানী মোগাডিসুতে। আইয়ান হিরসি আলীর বাবা হিরসি মাগান ইসে ছিলেন রাজনীতিবিদ ও পন্ডিত। মাত্র ৫ বছর বয়েসে আইয়ান হিরসি আলীকে ‘খৎনা’-র ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মূখীন হতে হয়। নারীর খৎনাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় Clitorectomyবলা হয়। অহেতুক যন্ত্রণাদায়ক এই ঘৃন্য প্রথাটি আফ্রিকাসহ আরববিশ্বের অনেক নারীর জীবনকে করে তোলে বিষময়। হিরসি মাগান ইসে-র অবশ্য তাঁর মেয়ের Clitorectomy করার ব্যাপারে অমত ছিল। তবে তিনি তখন জেলে ছিলেন বলে তিনি ঐ ‘অপকর্মে’ বাধা দিতে পারেননি।
আইয়ান হিরসি আলীর ৮ বছর বয়েসে তার পরিবার চলে আসে সৌদি আরব; সেখান থেকে ইথিওপিয়া। পরে পরিবারটি সেটল করে কেনিয়ায়। নাইরোবির মুসলিম গালর্স সেকেন্ডারি স্কুলে ভর্তি হয়ে ইংরেজি শেখে আইয়ান হিরসি আলী। তবে, মেয়েবেলা থেকেই ইসলাম ধর্মে শিক্ষা হয়েছিল। পড়তে হত কোরান।
কেনিয়ার শিক্ষাব্যবস্থায় প্রচুর অর্থ ঢালে সৌদি আরব । ফলে, আইয়ান হিরসি আলী কট্টর ওয়াহাবী শিক্ষা পেয়েছিল। স্কুলের ইউনিফর্মের সঙ্গে পরতে হত হিজাব । ওয়াহাবী শিক্ষার তুলনায় সোমালিয়া ও কেনিয়ার ইসলাম ছিল অনেকটা সহনশীল হলেও ওয়াহাবীপন্থি শিক্ষকদের প্ররোচনায় মিশরের কুখ্যাত জঙ্গি সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠে আইয়ান হিরসি আলী । মুসলিম আলেমরা ব্রিটিশ লেখক সালমান রুশদীর বিরুদ্ধে ফতোয়া দিলে আইয়ান হিরসি আলী সমর্থন জানায়।
মেয়েবেলা থেকেই বই পড়তে ভালো লাগত আইয়ান হিরসি আলীর। কেনিয়ায় থাকাকালে প্রচুর ধর্মনিরপেক্ষ বই পড়ার সুযোগ হল। এভাবে মনের গড়ন বদলে যাচ্ছিল মেয়েটির।
কিছু সংশয় তৈরি হচ্ছিল।



১৯৯২ সাল। আইয়ান হিরসি আলীর বাবা তার মেয়ের বিয়ে ঠিক করে। ‘আগন্তুক দ্বারা ধর্ষিতা হব না’-এই শপথ নিয়ে আইয়ান হিরসি আলী বিদেশ পাড়ি জমাবে ভাবল। পলিটিকাল অ্যাসাইলামের অজুহাতে কাগজপত্র সেভাবেই তৈরি করল-করে নেদারল্যান্ডে পৌঁছল। যা হোক, হল্যান্ডে বসবাসের অনুমতি পেল। আমসট্রাডাম শহর। কাজ খুঁজল। অড জব। পেল। ডাচ ভাষা শিখল। ডাচদের সমাজ দেখে মুগ্ধ আইয়ান হিরসি আলী-বিশেষ করে নারীস্বাধীনতার বিষয়টি। সময় পেলেই বই পড়ত। এই প্রথম ফ্রয়েড পড়ে বিস্মিত হল। ধর্ম ব্যতীত যে নৈতিকতা সম্ভব- তা জেনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়বে বলে ঠিক করল। ভর্তি হল লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ।
২০০০ অবধি চলল পড়াশোনা।



রাস্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ পাস করে আইয়ান হিরসি আলী রাজনীতি করবেন ভাবলেন। যোগ দিলেন একটি মধ্য-বাম শ্রমিক দলে। পড়াশোনা চলছিল। ইসলাধর্মে আর বিশ্বাস ধরে রাখা যাচ্ছিল না। ৯/১১ পর তার ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে বিব্রত বোধ করলেন। লাইডেন অধ্যাপক দার্শনিক হেরমান ফিলিপস ‘দি অ্যাথেইস্ট ম্যানিফেস্টো’ নামে একটি ক্ষুদ্র বই লিখেছিলেন। বইটি পড়ে পুরোপুরি অবিশ্বাসী হয়ে গেলেন আইয়ান হিরসি আলী। ২০০২ সালে ইসলাম ত্যাগ করে নিজেকে অ্যাথেইস্ট ভাবতে শুরু করলেন। ইসলামের সমালোচনা করে নিবন্ধ লেখতে শুরু করলেন। সমকাম ও পরকীয়ার ইসলামের ধ্বজাধারীরা যে শাস্তি দেয়-তার কট্টর সমালোচনা করলেন। লিখলেন: ‘৯/১১ এর খুনিদের আর আমার ঈশ্বর এক হতে পারে না।’ ইসলামকে বললেন, পিছিয়ে পড়া ধর্ম-যা কি না গনতন্ত্রের সঙ্গে কমপাটিবল না। তাঁর মতে, ইসলাম হল নয়া ফ্যাসীবাদ। খিলাফত চলে শরিয়া আইনে। যেখানে বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হলে পাথর ছুঁড়ে মারা হয়, সমকামীদের মারা হয় বেত -আর অবিশ্বাসীদের করা হয় হত্যা । ইসলাম নাৎসীবাদ না তো কী! আইয়ান হিরসি আলী মেয়েদের Clitorectomy বিরোধী। তাঁর মতে, Clitorectomy যৌনআকাঙ্খা দূর তো করেই না-উপরোন্ত তা হয়ে দাঁড়ায় যন্ত্রণাদায়ক। Clitorectomy করা মেয়েরা জীবনভর যন্ত্রণা সহ্য করে ।
এসব নিয়েই “দি সন ফ্যাক্টরি” নামে বই লিখলেন আইয়ান হিরসি আলী ।
বিপদ ঘনিয়ে এল।
হল্যান্ডের একটি (মুসলিম) জঙ্গি সংগঠনের নাম:হোফসটাড নেটওয়ার্ক। হল্যান্ডে প্রায় ১০ লক্ষ মুসলিম বাস করে। হোফসটাড নেটওয়ার্ক মুসলিম ডাচদের একটি মৌলবাদী যুব সংগঠন। দীর্ঘকাল ধরেই তারা ইউরোপে তাদের (অপ) তৎপরতা চালিয়ে আসছিল। স্পেন ও বেলজিয়ামেও নাকি এদের শাখা আছে। মিশরীয় মুসলিম সংগঠন, ‘তাকফির ওয়াল হিজরার’ আদর্শে হোফসটাড নেটওয়ার্ক-এর সদস্যরা অনুপ্রাণিত।
হোফসটাড নেটওয়ার্ক-এর কাছ থেকেই প্রথম মৃত্যুর হুমকি পেলেন আইয়ান হিরসি আলী। তবে, ঘাবড়ালেন না। লেখা চালিয়ে গেলেন। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তকের কঠোর সমালোচনা করে লিখলেন; ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বিকৃতরুচির একজন pedophileছিলেন। pedophile শব্দের অর্থ: An adult who is sexually attracted to children! ৫২ বছর বয়েসে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা ৬ বছরের শিশু আয়েশাকে বিবাহ করেন। আর, বালিকা আয়েশার ৯ বছর বয়েস যৌনমিলন হয়!
হোফসটাড নেটওয়ার্ক-এর সদস্যরা ক্রদ্ধ হয়ে উঠতে থাকে।
ঠিক এই সময়েই থিও ভ্যান গগ-এর সঙ্গে পরিচয় হল তাঁর।


থিও ভ্যান গগ। ওলন্দাজ (ডাচ) চিত্রপরিচালক, প্রয়োজক, কলামিষ্ট, লেখক ও অভিনেতা। বিখ্যাত চিত্রকর ভ্যান গগ এঁরই উর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ। আইয়ান হিরসি আলীর লেখা পড়ে চমৎকৃত হয়েছিলেন থিও ভ্যান গগ। তিনি নিজেও শাস্ত্রবিরোধী। আইয়ান হিরসি আলীর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একটি ছবি নির্মান করবেন ভাবলেন। আইয়ান হিরসি আলীই চিত্রনাট্য লিখলেন। মাত্র ১০ মিনিটের ছবি। তাতেই যা বলার বলা গেল। থিও ভ্যান গগ নিজেই স্বল্পদৈর্ঘ্যরে চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা ও পরিচালনা করলেন। নাম রাখলেন: ‘সাবমিশন।’ থিও ভ্যান গগ তখনও জানতেন না ঘনিয়ে আসছে মৃত্যু। ইসলাম নারীদের কী চোখে দেখে ১০ মিনিটের ছবিতে সে কথাই উঠে এসেছে। দুটো কথা বড় বিপদজনক। (১) অবাধ্য হলে মেয়েদের মারধোর করা যাবে। (২) রাজী না হলে-তারপর যা হবে-তা ধর্ষনেরই শামিল!
মূলত; আত্মসমর্পন আল্লার প্রতি মানুষের নয়-পুরুষের প্রতি নারীর!



‘সাবমিশন’ ছবিটি রিলিজ পায় ২৯ আগস্ট ২০০৪। (আমি সরাসরি ছবিটার লিঙ্ক দিলাম না। Submission লিখে গুগল সার্চ করলে আশা করি ইউ টিউবে ১০ মিনিটের ছবিটি পেয়ে যাবেন। ) ছবিটি রিলিজ পাওয়ার পর হল্যান্ডের মুসলিম কমিউনিটিতে প্রচন্ড বিক্ষোভ দেখা যায়। হোফসটাড নেটওয়ার্কসহ ইউরোপের ইসলামী মৌলবাদী সংগঠনগুলি ফেটে পড়ে তীব্র আক্রোশে। অর্ধনগ্ন অভিনেত্রীর শরীরের পবিত্র কোরানের আয়াত! মোহাম্মদ বোওয়েরি। ২৬ বছর বয়েসি মরক্কোর যুবক; ডাচ নাগরিক। হোফসটাড নেটওয়ার্কের সদস্য। সিদ্ধান্ত নিল-সে থিও ভ্যান গগ এবং আইয়ান হিরসি আলীকে খুন করবে!
আমসট্রাডাম। ২০০৪। নভেম্বর মাসের ২ তারিখ; সকাল। থিও ভ্যান গগ সাইকেল করে যাচ্ছিলেন কাজে। মোহাম্মদ বোওয়েরি কাছ থেকে এইচ এস ২০০০ হ্যান্ডগান দিয়ে আটবার গুলি করে। তক্ষনাৎ মৃত্যু হয় থিও ভ্যান গগ এর। মোহাম্মদ বোওয়েরি তারপর ধারালো ছুড়ি বের করে থিও ভ্যান গগ এর গলা কেটে ফেলে। বুকে তীক্ষ্ম ছোরা দিয়ে ষ্ট্যাব করে। বুকের ওপর মিশরী সংগঠন তাকফির ওয়াল হিজরার রেফারেন্সসমেত একটা নোট গেঁথে দেয়। নোটে পশ্চিমা সরকার ইহুদিবাদ ও আইয়ান হিরসি আলীর ধ্বংস কামনা করা হয়।
পালানোর সময় পুলিশ মোহাম্মদ বোওয়েরি পায়ে গুলি করে।
সে ধরা পড়ে।
তার বিচার হয়।
সে এখন যাবৎজ্জীবন কারাদন্ড ভোগ করছে।
থিও ভ্যান গগ-এর মৃত্যুর পর আইয়ান হিরসি আলী মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়লেও নিজের বিশ্বাস থেকে বিন্দুমাত্র টলে যাননি। নিহত থিও ভ্যান গগ-এর মা পুত্রশোক কাটিয়ে উঠে বললেন: আমি আমার ছেলের আদর্শে বিশ্বাস করি।
বর্তমানে ডাচ সরকারের তত্ত্বাবধানে আইয়ান হিরসি আলী লোকচক্ষুর অন্তরালে আছেন।
এই জন্যই বলছিলাম, এই আধুনিক সময়েও পুরনো শাস্ত্রের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না। বললে মৃত্যু অনিবার্য।



অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাতের সাম্প্রতিক এক গবেষনায় জানা গেছে বাংলাদেশে বছরে দশ (১০) লক্ষ করে ধর্মান্ধ জঙ্গি বাড়ছে! এদের অর্থায়নের যে টাকা লগ্নি করা হয়েছে তার টার্নওভারের পরিমান দেড় হাজার কোটি টাকার মতন!
হয়তো, থিও ভ্যান গগ এবং আইয়ান হিরসি আলী ‘সাবমিশন’ নির্মান করে বাড়াবাড়ি করেছেন। কিন্তু, একবার ভেবে দেখুন- আমরা টিভিতে রোজ যে নাটক/চলচ্চিত্র দেখছি-যা আমাদের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি- সেসবও তো বাংলাদেশি জঙ্গিদের সহ্য হওয়ার কথা না। তার ওপর জঙ্গিদের পিছনে রয়েছে অঢেল অর্থ।
কার্যত, আমরা কেউই নিরাপদ নই।

উৎস:

http://en.wikipedia.org/wiki/Submission_(film)

http://en.wikipedia.org/wiki/Ayaan_Hirsi_Ali

Click This Link)



রোজনামচা বলেছেন:

শয়তানের আওয়াজ বলে সঙ্গীতকে এরা
হারাম করতে চায়-
আমি তাতে দুঃখ পাই।
এবং
‘মধ্যযুগের আফিম’ বলে ধর্ম-কথাকে ওরা
নিষিদ্ধ করতে চায়,
আমি তাতে ক্ষুদ্ধ হই।

দিন রাত মাইকে মাইকে সারা শহরে
গানের যে ঝালাপালা,
ত্যক্ত হয়ে লোকেরাই একদিন গানকে
‘হারাম’ করার ব্যবস্থা করবে,
তাতে এদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে-
কিন্তু আমি দুঃখ পাব।

এবং
দিন রাত মাইকে মাইকে সারা শহরে
ধর্ম কথার যে হাঁক-ডাক,
তিক্ত হয়ে লোকেরাই একদিন,
ধর্ম-কথাকে নিষিদ্ধ করবে,
তাতে ওদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে-
কিন্তু আমি ক্ষুদ্ধ হব।



আপনার পোস্টটা পড়ে আবারো দু:খ পেলাম, ক্ষুদ্ধ হলাম। ধন্যবাদ আপনাকে।
ইসলামের নাম করে যে নির্যাতন আইয়ান হিরসি আলীদের ওপর হচ্ছে তা তাদের জীবনকে অসহনীয় করে তুলছে। এসব আমাকে ক্ষুদ্ধ করে। কিন্তু যখন দেখি আলী'রাও উল্টো ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে সামষ্টিকতাকে মোটাদাগে আক্রমন করে অন্ধের মত তখন দু:খ পাই।

অতএব-
লক্ষন যা, তাতে দুঃখ আর ক্ষোভই
আমার কপালের লেখা।

2 comments:

Anonymous said...

Buy Cialis, Viagra, Levitra, Tamiflu. Order Generic Medication In own Pharmacy. Buy Pills Central.
[url=http://buypillscentral.com/buy-generic-tamiflu-online.html]Discount Viagra, Cialis, Levitra, Tamiflu Pharmacy No prescription[/url]. Indian generic drugs. Cheap drugs pharmacy

Anonymous said...

But silent, there are well known companies which be entitled to benefit words and created an excellent Discount Viagra Pharmacy Online reputation.