Sunday, April 26, 2009

১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস; মুহম্মদ জাফর ইকবাল

যেহেতু এখানে সরাসরি কোনো বই/ ডকুমেনন্টস আপলোড করা যায় না, তাই আমি নিচে লিংক দিলাম।
এবার থেকে কিছু ভালো বই বা ডকুমেনন্টস এর লিন্ক দেবার চেষ্টা করব।

http://www.scribd.com/doc/14650398/1971-Jafor-Iqbal

Sunday, April 19, 2009

আপনার কম্পিউটার এর বেসিক তথ্য জানুন

আপনার পিসিটির বেসিক সব তথ্য যা আপনার প্রয়োজন হতে পারে যেকোন সময়। আর জানতে হলে অনেক গুলো উপায়ের মধ্যে সবচেয়ে চমৎকার পদ্ধতি বোধহয় এটাই । ট্রাই করে দেখেন;

Click on Start Menu
Run এ CMD লিখে এন্টার দিন।
কমান্ড প্রম্পট আসলে লিখুন systeminfo
এবার এন্টার দিন।
ব্যস হয়ে গেল। দেখুন আপনার পিসির নাড়ী ভূড়ীর খবরা খবর বাহির হয়ে আছে।
মজা পাইলে থ্যাঙ্কু দেন, না পাইলেও দেন। কষ্ট কইরা লিখছি।

Thursday, April 9, 2009

গত নির্বাচনে দুই নেত্রীর হলফনামা

সুত্র: http://priyo.com/forum/20081208/16993

বাগেরহাট-১ আসনে হাসিনার সম্ভাব্য ব্যয় ১১ লাখ টাকা
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবার সম্ভাব্য নির্বাচনী ব্যয় ধরেছেন ১১ লাখ টাকা। এই টাকা তিনি নিজ তহবিল থেকে খরচ করবেন।

বাগেরহাট-১ আসনে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া হলফনামায় শেখ হাসিনা এই তথ্য দিয়েছেন। তিনি এবার বাগেরহাট ছাড়া গোপালগঞ্জ-৩ এবং রংপুর-৬ আসন থেকেও প্রার্থী হয়েছেন।

বাগেরহাটের মতো গোপালগঞ্জ-৩ আসনের মনোনয়নপত্রেও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী একই তথ্য দিয়েছেন। উভয় মনোনয়নপত্রে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শিক্ষাগত যোগ্যতা ‘বিএ’ এবং পেশা রাজনীতি বলে উল্লেখ করেছেন।

মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া আয়কর হিসাব বিবরণী অনুযায়ী, শেখ হাসিনার সম্পদের প্রকৃত পরিমাণ তিন কোটি ৫৪ লাখ দুই হাজার ৯০৪ টাকা। তাঁর বছরে মোট আয় ২৯ লাখ ৭৭ হাজার ৬৭ টাকা। এর মধ্যে গৃহসম্পত্তি থেকে আয় চার লাখ ৪৮ হাজার টাকা, কৃষি থেকে আয় সাড়ে চার লাখ টাকা এবং ব্যাংকে আমানতের ওপর পাওয়া সুদ থেকে আয় ২০ লাখ ৭৯ হাজার ৬৭ টাকা।

শেখ হাসিনার সম্পত্তির মধ্যে আছে কৃষিজমি: নিজ নামে চার একর (অর্জনকালীন মূল্য পৌনে দুই লাখ টাকা), স্বামীর নামে এক একর (মূল্য: ১৫ হাজার টাকা)। যৌথ মালিকানাধীন পাঁচ একর জমির অর্ধেকের মালিক তিনি। দালান ও বাড়ি আছে, যার অর্জনকালীন মূল্য ৬৪ লাখ তিন হাজার ৯৫২ টাকা। গাড়ি আছে দুটি, যার একটির (ক্রয়মূল্য) ছয় লাখ টাকা এবং আরেকটি উপহার হিসেবে পেয়েছেন। স্বর্ণালংকার আছে ১৩ লাখ ২৫ হাজার টাকার ও আসবাবপত্র সাত লাখ ৪০ হাজার টাকার।

শেখ হাসিনার কাছে এখন নগদ ও ব্যাংকে জমা আছে তিন কোটি ১৮ লাখ ৮৪ হাজার ৯০৪ টাকা।
তাঁর বছরে পারিবারিক ব্যয় দুই লাখ টাকা। মোটরযান-সংক্রান্ত খরচ বছরে ২০ হাজার টাকা। তিনি গত অর্থবছরে পারিবারিক ব্যয় ও আয়কর দেওয়াসহ খরচ করেন ১০ লাখ ৯৫ হাজার ৩৫১ টাকা। তাঁর কোনো প্রকার ঋণ বা দায় নেই বলেও উল্লেখ আছে।
হলফনামা অনুযায়ী, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বর্তমানে ফৌজদারি মামলার সংখ্যা ১৬টি। এর মধ্যে ১০টি হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত, চারটি তদন্তাধীন, একটি পুনঃতদন্তাধীন ও একটির অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় চুড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। অতীতে ফৌজদারি মামলার সংখ্যার কলামে বলা হয়েছে, মামলা হয়েছিল। তবে মামলা নম্বর ও যে আদালত মামলা আমলে নিয়েছিল, তা জানা নেই। তবে ফলাফল বেকসুর খালাস।

শেখ হাসিনা ইতিপূর্বে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে ভোটারদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণসংক্রান্ত ঘরে দীর্ঘ বিবরণ দিয়েছেন। এর মধ্যে নির্বাচনী ইশতেহার মোতাবেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তা, সেতু, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, গৃহায়ণ কর্মসুচি, বৃদ্ধাশ্রম, শিক্ষা উপবৃত্তি, আর্সেনিকমুক্ত পানি প্রকল্প, দুস্থ পুনর্বাসন ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপনসহ বিভিন্ন উন্নয়ন ও সামাজিক কার্যক্রমে ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ পূরণ করেছেন।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন: আহাদ হায়দার, বাগেরহাট ও সুব্রত সাহা বাপী, গোপালগঞ্জ

ফেনী-১ আসনে খালেদার সম্ভাব্য ব্যয় পাঁচ লাখ টাকা
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ার-পারসন খালেদা জিয়ার ফেনী-১ আসনে (পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া) এবার নির্বাচনে সম্ভাব্য ব্যয় বরাদ্দ পাঁচ লাখ টাকা। তিনি বাড়ি ভাড়া ও ব্যাংকে জমা রাখা টাকার সুদ থেকে এই টাকা খরচ করবেন। মনোনয়নপত্রের সঙ্গে তাঁর জমা দেওয়া হলফনামায় তিনি এ তথ্য দিয়েছেন।

মনোনয়নপত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘরে খালেদা জিয়া লিখেছেন ‘স্বশিক্ষিত’। তিনি কোনো শিক্ষাসনদ জমা দেননি। পেশা উল্লেখ করেছেন রাজনীতি। গত নির্বাচনে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ঘরে উল্লেখ করেছেন ‘প্রযোজ্য নয়’।

মনোনয়নপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত গত ৬ নভেম্বর জমা দেওয়া আয়কর বিবরণী অনুযায়ী খালেদা জিয়ার সম্পদের প্রকৃত পরিমাণ তিন কোটি ৭৩ লাখ ৪৭ হাজার ৫৩৫ টাকা। বছরে তাঁর মোট আয় ১২ লাখ ৯৭ হাজার ১৮৩ টাকা। এর মধ্যে বছরে বাড়ি ভাড়া থেকে পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ৮০০ টাকা এবং ব্যাংকে রাখা আমানত থেকে সুদ বাবদ সাত লাখ ৭৩ হাজার ৩৮৩ টাকা আয় করেন তিনি।

মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার তারিখ পর্যন্ত তাঁর অস্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে হাতে নগদ ৩৬ লাখ ৫২ হাজার ৮৪৫ টাকা। আর ব্যাংকে জমা আছে দুই কোটি ৭৫ লাখ ৪২ হাজার ২৮৫ টাকা। এ ছাড়া তিনটি গাড়ি− ১৬০০ সিসি মোটর কার, টয়োটা জিপ, নিশান জিপ। দাম দেখান হয়েছে কেনার সময়ের−৫৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। তাঁর ৫০ তোলা স্বর্ণালংকার আছে, যা বিয়ের সময় উপহার হিসেবে পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন খালেদা জিয়া। ইলেক্ট্রনিকসামগ্রী আছে চার লাখ ৩৫ হাজার টাকার এবং আসবাব দুই লাখ ৬০ হাজার টাকা মূল্যের।
খালেদা জিয়ার গৃহসম্পত্তির মধ্যে বাড়ি ও দালান আছে দুটি। একটি ঢাকা সেনানিবাসের ৬ শহীদ মইনুল সড়কে; আরেকটি ১৯৬, গুলশান এভিনিউ, ঢাকায়। বাড়ি দুটির অর্জনকালীন মূল্য উল্লেখ করা হয়েছে যথাক্রমে পাঁচ টাকা ও ১০০ টাকা। প্রসঙ্গত, বাড়ি দুটি সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের আমলে দেওয়া। এ ছাড়া উত্তরা থানার উত্তরখানে আট শতাংশ জমি (দাম তিন হাজার ৩০০ টাকা) ও সাভারে ১৭৬৮ অযুতাংশ জমি রয়েছে বিএনপির নেত্রীর। তাঁর কোনো ঋণ বা দায় নেই।

খালেদা জিয়া তাঁর বাৎসরিক মোট ব্যয় উল্লেখ করেছেন তিন লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যক্তিগত ভরণ-পোষণ এক লাখ ২০ হাজার টাকা। যানবাহনসংক্রান্ত যাবতীয় খরচ ৮৪ হাজার টাকা এবং উৎসবসহ অন্যান্য বিশেষ ব্যয় ৯৬ হাজার টাকা।

মামলা: খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের আমলে দায়ের করা ফৌজদারি মামলার সংখ্যা চার এবং সবই হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত আছে বলে হলফনামায় উল্লেখ করা হয়। অতীতে ফৌজদারি মামলার সংখ্যা শীর্ষক কলামে বলা হয়েছে, মামলা হয়েছিল। তবে মামলা নম্বর এবং কোন আদালত মামলা আমলে নিয়েছিলেন, তা জানা নেই। তবে ফলাফল বেকসুর খালাস।

খালেদা জিয়া বগুড়া-৬ ও ৭ নং আসনে চার দলীয় জোটের প্রার্থী হয়েছেন। মনোনয়নপত্রে খালেদা জিয়া শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে ‘স্বশিক্ষায় শিক্ষিত’ বলে উল্লেখ করেছেন।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন আবু তাহের, ফেনী

যদি দেশের সমস্ত অনাথ দের উপর আল্লাহ এমন রহম করতো! by Mr. ANIK

জিয়ার মৃত্যুর পর যদি কিছু মনে না করেন অনুষ্ঠানে ছেড়া গেঞ্জী এবং ভাঙা সু্টকেসের কাহিনী শুনে কান্নার রোল ছড়িয়ে পড়ে ছিল ঘরে ঘরে । অফিস আদালত থেকে কোর্ট কাচারীতে একই প্রশ্ন ছিল এই স্বল্প শিক্ষিত অসহায় বিধবার প্রতিদিনের অন্ন যোগাড়, মাথা গোঁজার এতটুকু ঠাই, এতিম সন্তানদের পড়াশোনার ব্যয় কিভাবে নির্বাহ হবে । কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে? সেই সময় তার পাশে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল কোমল মনের এরশাদ সাহেব । মাথা গোঁজার জন্য দিলেন বাড়ি। মাত্র ৫ টি টাকার নোটের বদলে নিরাপদ সেনানিবাসের এলাকায়।

এরপর এই মহীয়সী নারীর উপর উপরওয়ালার মেহেরবানীতে বরকতের দুয়ার খুলে গেল । মাত্র দুই যুগের কিছু সময়ে বছরে ১৩ লাখ টাকা আয়ের একটি পরিবার এবং পোনে চার কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক বানিয়ে দিলেন উপরওয়ালা।

দেশের হাজারও এতিম গরীব বিধবারা নামাজের সেজদায় কত পড়ে । আল্লাহ কে ডাকে। তাদের কপাল খোলে না । মঙ্গায় বন্যায় তারা ধু্ঁকে ধুঁকে মরে । খালেদা জিয়ার উপর যে রকম রহমত নাজিল হয়েছে যদি একই রকম রহমত তাদের উপর নাজিল হতো, বিশ্ব ব্যাঙ্ক, আইএমএফের কাছে হয়তো আমাদের হাত পাততে হতো না ।


চলুন এক নজরে দেখি রহমতের কিছু নজির:
----------------------------------------------------------------
মনোনয়নপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত গত ৬ নভেম্বর জমা দেওয়া আয়কর বিবরণী অনুযায়ী খালেদা জিয়ার


সম্পদের প্রকৃত পরিমাণ : ৩,৭৩, ৪৭, ৫৩৫.০০ টাকা
বছরে তাঁর মোট আয় : ১২, ৯৭, ১৮৩.০০ টাকা
ক. বছরে বাড়ি ভাড়া থেকে আয়: ৫, ২৩, ৮০০.০০ টাকা
খ. ব্যাংকে রাখা আমানত থেকে সুদ: ৭,৭৩, ৩৮৩.০০ টাকা

মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার তারিখ পর্যন্ত তাঁর অস্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে
ক. হাতে নগদ (ক্যাশ): ৩৬,৫২, ৮৪৫.০০ টাকা
খ. ব্যাংকে জমা আছে: ২,৭৫, ৪২, ২৮৫.০০ টাকা
গ. ‌১৬০০ সিসি মোটর কার,
ঘ. টয়োটা জিপ,
ঙ. নিশান জিপ
দাম দেখান হয়েছে কেনার সময়ের: ৫৪, ৪৫,০০০.০০ টাকা

চ. স্বর্ণ: তাঁর ৫০ তোলা স্বর্ণালংকার আছে, যা বিয়ের সময় উপহার হিসেবে পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন খালেদা জিয়া।
ছ. ইলেক্ট্রনিকসামগ্রী: ৪, ৩৫,০০০ টাকার
জ. আসবাব: ২, ৬০,০০০ টাকার

খালেদা জিয়ার গৃহসম্পত্তির মধ্যে
ঝ. ৬ শহীদ মইনুল সড়কের বাড়ি: ৫.০০ টাকা
ঞ. ১৯৬, গুলশান এভিনিউর বাড়ি(অর্জনকালীন মূল্য): ১০০.০০ টাকা

জমি
চ. উত্তরা থানার উত্তরখানে আট শতাংশ জমি: ৩, ৩০০০.০০ টাকা
ছ. সাভারে ১৭৬৮ অযুতাংশ জমি

ঋণ এবং ব্যয়:
ক. তাঁর কোনো ঋণ বা দায় নেই।
খ. বাৎসরিক মোট ব্যয়:
তিন লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যক্তিগত ভরণ-পোষণ এক লাখ ২০ হাজার টাকা। যানবাহনসংক্রান্ত যাবতীয় খরচ ৮৪ হাজার টাকা এবং উৎসবসহ অন্যান্য বিশেষ ব্যয় ৯৬ হাজার টাকা।

Tuesday, April 7, 2009

জগৎজ্যোতি! যিনি ছিলেন বাংলার প্রথম বীরশ্রেষ্ঠ

ফিরে দেখা ইতিহাস
জগৎজ্যোতি! যিনি ছিলেন বাংলার প্রথম বীরশ্রেষ্ঠ
ভাস্কর চৌধুরী


একজন জগৎজ্যোতি! বাংলাদেশের প্রথম বীরশ্রেষ্ঠ! যাকে ’৭১ এর ১৬ নভেম্বর শহীদ হবার পর অনন্য বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ মরণোত্তর খেতাব প্রদানের ঘোষনা দেয়া হয়। কেন ঘোষনা দিয়েও জগৎজ্যোতিকে প্রদান করা হলো না মরনোত্তর সর্বোচ্চ খেতাব- এই প্রশ্নের উত্তর আজো অজ্ঞাত। জগৎজ্যোতির সহযোদ্ধা আর মুক্তিযোদ্ধাদের গবেষকরাও আজও খুঁজে বেড়ান এই প্রশ্নের উত্তর।

আর আজ তাকে নিয়েই এ আয়োজন।

সূর্যের লাল আভাটা পশ্চিমাকাশে! সময় তার শেষ সন্ধায় দাঁড়িয়ে। যুদ্ধের মিশনে এক যোদ্ধার মরণপণ চালিয়ে যাওয়া ক্রান্তিকাল। সহযোদ্ধাদের পালানোর সুযোগ করে দিয়ে মরনপন লড়াই চালিয়ে যাওয়া যোদ্ধা। হঠাৎ! পাশে থাকা সহযোদ্ধাও গুলিবিদ্ধ। নিজের মাথার গামছা খুলে বেঁধে রক্তপড়া বন্ধ করেন সহযোদ্ধার। পালানোর প্রস্তাব। কিন্তু না! গর্জে ওঠে তার বীরকন্ঠ। তেজোদীপ্ত সুরে বলে- ‘পালাবো না, সবকটাকে শেষ করে তবে যাবো।’ তারপর ! একাই ১২ জন পাকসেনাকে খতম। অস্ত্রভান্ডারও শূন্য। তবু পিছু ফেরা নয়! আচমকা একটা বুলেট সূর্যের লাল আভাটার ন্যায় বিদ্ধ হয় যোদ্ধার শরীরে। শেষবারের মতো চিৎকার করে ওঠা- ‘আমি যাইগ্যা’।
শেষ চিৎকার! সূর্যের প্রদীপ নিভে যাওয়ার সাথে সাথে এক যোদ্ধার আলোও নিভে যায়! বলছি যোদ্ধা নামের সেই ব্যক্তিটির কথা। যুদ্ধের ময়দানে যার হাত দিয়ে তৈরি হয় মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে ‘দাস পাটির্’। যাকে ’৭১ এর ১৬ নভেম্বর শহীদ হবার পর অনন্য বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ মরণোত্তর খেতাব প্রদানের ঘোষনা দেয়া হয়। সেই যোদ্ধা, সেই খেতাব যার গলায় পরার কথা তিনি আমাদের অহংকার ‘জগৎজ্যোতি’। আমাদের নিজস্ব মানচিত্র আর নিজস্ব পতাকার মালিকানা দিয়ে চিরদিনের জন্য বিদায় নেয় সেই ‘জগৎজ্যোতি’ দাস। অথচ তার প্রাপ্য সেই সর্বোচ্চ খেতাব আজও তাকে দিতে পারেনি দেশ!

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই মুক্তিযুদ্ধের উত্তরপূর্ব রণাঙ্গণের মুক্তি সেনাদের কাছে কিংবদন্তিতে পরিণত হয় জগৎজ্যোতির বীরত্বগাথা সংগ্রামের কাহিনী। আজও তার কথা ভুলতে পারেনি যুদ্ধকালীন সময়ে তার সহযোদ্ধারা। তাদের চোখে এখনো ভাসে জগৎজ্যোতির সাথে তাদের শেষ দেখা।

একটি সম্মুখযুদ্ধে পাকবাহিনীর দোসরদের কূটচালের ফাঁদে পড়ে আর নিজ সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে গিয়ে আত্ম উৎসর্গ করেন জগৎজ্যোতি দাস। তবে তার আগেই শহীদ জগৎজ্যোতি অমর বীরত্বগাথার মাধ্যমে নিশ্চিত করে যান আমাদের নিজস্ব মানচিত্র আর নিজস্ব পতাকার মালিকানা। বিগত আ’লীগ শাসনামালে শহীদ জগৎজ্যোতির পরিবারকে একখন্ড জমি দেয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে জগৎজ্যোতিরই নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সেই অঙ্গিকারটিও কেবল ফাঁকা বুলির মধ্যেই থেকে গেছে। বাস্তবায়িত হয়নি আজও। ফলে মুক্তিযুদ্ধের অনন্য অবদানের জন্য মরনোত্তর সর্বোচ্চ খেতাব অর্জনকারী প্রথম ব্যক্তিটির উত্তরসূরীরা এখন যাযাবরের মতো জীবন কাটাচ্ছেন। এককালে তাদের নিজেদের যে বাড়িটা ছিলো, ’৭১-এ জগৎজ্যোতিকে হত্যা করে সেই বাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো হায়েনারা। তারপর অভাবের তাড়নায় ভিটেমাটিও বিক্রি করে ফেলে জগৎজ্যোতির পরিবার। এখন জগৎজ্যোতির উত্তরসূরীরা হবিগঞ্জে ভাড়া করা বাড়িতে থাকেন। দিনমুজুরের কাজ করে টেনে চলেন জীবিকার জোয়াল।


একজন ‘জগৎজ্যোতি’
গ্রামের নাম জলসুখা। হবিগঞ্জের আজিমিরগঞ্জ উপজেলার ছোট্ট একটি গ্রাম। সেই গায়ের জীতেন্দ্র চন্দ্র দাস ও হরিমতি দাসের কনিষ্ঠ পুত্র জগৎজ্যোতি দাস। জগৎজ্যোতির জন্ম ১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল। বাবা ও বড় ভাই রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন।
দারিদ্রতার সাথে লড়াই করেই ১৯৬৮ সালে ২য় বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন জগৎজ্যোতি।


দাস পার্টি
১৯৭১ সালে জগৎজ্যোতি ছিলেন সুনামগঞ্জ ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সারির কর্মী। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেয়ার লক্ষে সদলবলে ভারতের শিলংয়ে ট্রেনিং নিতে যান তিনি। নেতৃত্বগুন সম্পন্ন, নেতৃত্বের প্রতি সংবেদনশীলতা, কঠোর পরিশ্রমি এবং ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার দক্ষতা থাকার কারনে সে দলের নেতা মনোনিত হন জগৎজ্যোতি। জ্যোতির নেতৃত্বাধীন এই দলটিই পরবর্তীতে ‘দাস পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানী ও রাজাকারদের কাছে দাস পার্টি ছিলো মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। আর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সাফল্যের প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের অধীনে বিস্তৃর্ণ ভাটি অঞ্চল শত্রুমুক্ত রাখার দায়িত্ব পড়ে জগৎজ্যোতির উপর। দিরাই, শাল্লা, ছাতক, আজমিরিগঞ্জ, বানিয়াচং, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার নৌপথ পাক দখলমুক্ত রাখার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় জ্যোতির দাসপার্টি। ভাটির জনপদে শত্রুদের ভীত কাঁপিয়ে দেন জগৎজ্যোতি। দাস পার্টির মূহুর্মূহ আক্রমনে দিশেহারা হয়ে পাকিস্তান সরকার রেডিওতে ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়, এই রুট দিয়ে চলাচলকারী ব্যক্তিদের জানমালের দায়িত্ব সরকার নেবে না।
মাত্র ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বানিয়াচংয়ে প্রায় ২৫০ পাক বাহিনী ও তাদের দোসরদের ঠেকিয়ে দেন জ্যোতি। এ লড়াইয়ে প্রাণ হারায় শত্রু পরে ৩৫ সদস্য। পাকিস্তানিদের গানবোট ধ্বংস করে দেন জগৎজ্যোতিরা। ১৭ আগস্ট পাহাড়পুড়ে জগৎজ্যোতির বুদ্ধিমুত্তা ও বীরত্বে রক্ষা পায় অসংখ্য নিরীহ বাঙালির প্রাণ ও নারীর সম্ভ্রব। এখানেও পিছু হটে পাকিস্তানীরা। এরপর একের পর এক যুদ্ধজয়ী অভিযান চলতে থাকে জগৎজ্যোতির নেতৃত্বাধীন দাস পার্টির।


যুদ্ধের ময়দানে জগৎজ্যোতি
জগৎজ্যোতি একদম একা হাতে একটা এলএমজি নিয়ে দখল করে নেন জামালগঞ্জ থানা ভবন। সেখানে আস্তানা গেড়েছিলো রাজাকাররা। এরপর জামালগঞ্জ মুক্ত করার অভিযানে রাখেন গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা। এ সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন জগৎজ্যোতির সহযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম। মাত্র ১০/১২ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে শ্রীপুর শত্রুমুক্ত করেন জগৎজ্যোতি। খালিয়াজুড়ি থানায় ধ্বংস করে দেন শত্রুপরে বার্জ। আগস্ট মাসে দিরাই-শাল্লায় অভিযান চালিয়ে কোনরূপ গুলি ব্যয় না করেই কৌশলে আটক করেন ১০ জন রাজাকারের একটি দলকে। যারা এলাকায় বেপোরোয়াভাবে খুন, ধর্ষণ ও লুটপাট চালাচ্ছিলো। রানীগঞ্জ ও কাদিরীগঞ্জে অভিযান চালিয়েও জ্যোতি আটক করেন রাজাকারদের। জগৎজ্যোতি তখন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এক কিংবদন্তির নাম। সাহস ও অনুপ্রেরণার উৎস।


চক্রব্যুহে অভিমন্যু
১৬ নভেম্বর ভোরের সূর্য ওঠার সাথে সাথেই দাস পার্টির ৪২ সদস্য নিয়ে নৌকাযোগে বাহুবল অভিযানে রওয়ানা দেন জগৎজ্যোতি। ল্ক্ষ্যস্থলে যাওয়ার পূর্বেই বদলপুর নামক স্থানে হানাদারদের পাতা ফাঁদে পা আটকে ফেলেন জগৎজ্যোতি। বদলপুরে পৌঁছামাত্রই জগৎজ্যোতি দেখতে পান ৩/৪ জন রাজাকার ব্যবসায়ীদের নৌকা আটক করে চাঁদা আদায় করছে। ক্ষুব্ধ জ্যোতি রাজাকারদের ধরে আনার নির্দেশ দেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের দেখেই পিছু হঠতে থাকে রাজাকাররা। এতে আরো ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন জ্যোতি। ১০/১২ জন মুক্তিযোদ্ধা আর সামান্য গোলাবারুদ নিয়ে তাড়া করেন রাজাকারদের। অথচ কুচক্রীরা পাকসেনাদের বিশাল বহর আর প্রচুর সংখ্যক গোলাবারুদ নিয়ে একটু দূরেই ঘাপটি মেরে ছিলো। শুরু হয় এক জ্যোতির সীমিত গোলাবারুদের সাথে পাকবাহিনীর বিশাল অস্ত্রভান্ডারের এক অসমযুদ্ধ। এক পর্যায়ে গোলাবারুদ কমে আসায় বেকায়দায় পড়ে যায় দাস পার্টি। সঙ্গীদের জীবন বাঁচাতে স্থান ত্যাগের নির্দেশ দেন জ্যোতি। সহযোদ্ধাদের পালানোর সুযোগ করে দিয়ে মরনপন লড়াই চালিয়ে যান জগৎজ্যোতি ও তার সহযোদ্ধা ইলিয়াস। হঠাৎ করে ইলিয়াসও গুলিবিদ্ধ হন। নিজের মাথার গামছা খুলে জ্যাতি ভালো করে বেঁধে রক্তপড়া বন্ধ করেন ইলিয়াসের। ইলিয়াস পালানোর প্রস্তাব দেন। গর্জে ওঠে জগৎজ্যোতির বীরকন্ঠ।
তেজোদীপ্ত সুরে বলেন- ‘পালাবো না, সবকটাকে শেষ করে তবে যাবো।’ একাই ১২ জন পাকসেনাকে খতম করে দেন জ্যোতি। বিকেল পৌনে পাঁচটা। জ্যোতির অস্ত্রভান্ডার শূন্য। তবু পিছু ফিরছেন না। এমন সময় আচমকা একটা বুলেট বিদ্ধ হয় জ্যোতির শরীরে। জগৎজ্যোতি শেষবারের মতো চিৎকার করে ওঠেন- ‘আমি যাইগ্যা’।


মৃত জগৎজ্যোতিতেও ভীত রাজাকারেরা
জগৎজ্যোতির নিথর দেহকেও রেহাই দেয়নি পাক হায়েনাদের দোসররা। আজিমিরিগঞ্জ বাজারে যেদিন জ্যোতির লাশ আনা হয় সেদিন ছিলো ঈদের বাজার। বীর সেনার লাশ দেখতে শত শত লোক জড়ো হন বাজারে। মুক্তিযোদ্ধার পরিণতি দেখানোর জন্য জ্যোতির নিথর দেহ রাজাকাররা বেঁধে ফেলে ইলেকট্রিক খুঁটির সাথে। ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুঁচাতে থাকে জ্যোতির শরীর। তবিত করার পর বিবস্ত্র করা হয় এই প্রয়াত সেনাপতিকে। সদলবলে জ্যোতির গায়ে থু থু ফেলে রাজাকারের দল। এই বিভৎসতার স্মৃতি ধরে রাখতে এক দালালকে দিয়ে সেই ছবিও তুলানো হয়।
এইখানেই থামে না রাজাকাররা। জগৎজ্যোতির মা-বাবাকে নিয়ে জ্যোতির বিভৎস লাশ দেখিয়ে তারা বিকৃত আনন্দ উপভোগ করে। লাশ নিয়ে যখন পুরো পরিবারে কান্নার রোল উঠেছে তখন রাজাকারেরা আগুন ধরিয়ে দেয় জগৎজ্যোতিদের বসত ভিটায়। এরপর জগৎজ্যোতিকে ভাসিয়ে দেয়া হয় ভেড়ামোহনা নদীর জলে। এভাবেই ঘটে দেশ মাতৃকার শ্রেষ্ঠতম সন্তানটির ভাসানযাত্রা।


সর্বোচ্চ খেতাবের ঘোষণা
যুদ্ধ ক্ষেত্রে জ্যোতির শহীদ হবার সংবাদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, অল ইন্ডিয়া রেডিওসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়। সেই সাথে তার বীরত্বগাঁথা তুলে ধরা হয় বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার তাকে সর্বোচ্চ মরণোত্তর পদক প্রদানের ঘোষণা করেন। প্রথম ব্যক্তি হিসেবে জগৎজ্যোতিকে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক প্রদানের ঘোষণা সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত হয়। এই ঘোষণায় অনেক মুক্তিযোদ্ধাই উদ্‌ভুদ্ধ হয়েছিলেন, সাধুবাদ জানিয়েছিলেন সরকারকে।
জগৎজ্যোতিকে মরনোত্তর সর্বোচ্চ পদক প্রদানের ঘোষণা দিয়েও সে প্রতিশ্রুতি থেকে অজ্ঞাত কারণে সরে আসে সরকার। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে বীরবিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয় তাকে। এই পুরস্কারও বাস্তবে প্রদান করা হয় আরো দু’যুগ পর। কেন ঘোষনা দিয়েও জগৎজ্যোতিকে প্রদান করা হলো না মরনোত্তর সর্বোচ্চ খেতাব- এই প্রশ্নের উত্তর আজো অজ্ঞাত। জগৎজ্যোতির সহযোদ্ধা আর মুক্তিযোদ্ধাদের গবেষকরাও আজও খুঁজে বেড়ান এই প্রশ্নের উত্তর। তাদের নানা লেখায় প্রকাশ পেয়েছে এ নিয়ে ক্ষুভ।
মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী ‘একাত্তরের দিরাই-শাল্লা’ প্রবন্ধে লিখেছেন- ‘জগৎজ্যোতির প্রতি বাংলাদেশ সরকার তার প্রতিশ্রুতি রাখেনি। ··· স্বাধীনতার পর সরকার জ্যোতিকে সর্বোচ্চ খেতাব দেয়নি, সর্বোচ্চ খেতাব মুক্তিযুদ্ধের একটি বিশেষ অংশের জন্য সীমাবদ্ধ রয়ে গেলো। সরাসরি সশস্ত্রবাহিনীর না হলে সর্বোচ্চ খেতাব দেয়া যাবে না। অতএব জগৎজ্যোতিও বাদ। ওতে কিছু যায় আসেনি। জ্যোতিরও কোন ক্ষতি হয়নি। স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গকারী জগৎজ্যোতিরা অমর। তাদের কীর্তি অয় অবিস্মরণীয়।’


শহীদের তালিকায়ও নেই জ্যোতির নাম
স্বাধীনতার পর আজমিরিগঞ্জ উপজেলার নাম জগৎজ্যোতিগঞ্জ করার প্রস্তাব দেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। পরবর্তীতে স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরোধীতায় তা সম্ভব হয় নি। যদিও সুনামগঞ্জের পৌর পাঠাগারের নাম রাখা হয় জগৎজ্যোতি পৌর পাঠাগার নামে। তবে জগৎজ্যোতির নিজ জেলা হবিগঞ্জের স্মৃতিস্তম্ভে শহীদদের তালিকায়ও নাম নেই জগৎজ্যোতির। তাতে অবশ্য কিছু আসে যায় না জগৎজ্যোতির পরিবারের। যাদের নিজেদের থাকারই জায়গা নেই, খাওয়ার নিশ্চয়তা নেই- কার কোথায় নাম আছে তা নিয়ে ভাবার সময় কই এদের! জগৎজ্যোতির পিতা মাতা গত হয়েছেন। বড় ভাইও স্বর্গবাসী। এখন কেবল বৌদি আর ভাতুস্পুত্ররা আছেন। শহীদ জগৎজ্যোতি দাসের ভাতুস্পুত্র দুলালচন্দ্র দাস বলেন, জাতীয়ভাবে যেমন জগৎজ্যোতি দাসের সঠিক মূল্যায়ন করা হয়নি। তেমনি স্থানীয় ভাবেও তার মূল্যায়ন কেউ করেনি। তিনি বলেন, গত আ’লীগ শাসনামলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত হবিগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গায় আমাদের পরিবারকে বসবাসের জন্য একখন্ড জমি দেয়ার অঙ্গিকার করলেও তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি।


অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি
শহীদ জগৎজ্যোতির অমর বীরত্বগাথা আর বঞ্চনার কাহিনী নিয়ে এবারের বই মেলায় প্রকাশিত হয়েছে ‘অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি’ বইটি। বইটি লিখেছেন সাংবাদিক অপূর্ব শর্মা। সাহিত্য প্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে এটি। জগৎজ্যোতিকে নিয়ে বইটি লেখা হলেও আবশ্যিকভাবে ওঠে এসেছে সিলেট অঞ্চলের যুদ্ধদিনের কাহিনী। বীর সেনাদের বীরত্বগাঁথা আর রাজাকারদের পৈশাচিকতার গল্প। ইতিহাসধর্মী বইগুলোর চাইতে এই বইটির ব্যতিক্রম হলো ‘অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি’ বইটি সুখপাঠ্য ও প্রাঞ্জল। এই প্রতিবেদনের তথ্যগুলো অপূর্ব শর্মা’র অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি বইটি থেকে সংগৃহীত।



সংশপ্তক মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি আমাদের ক্ষমা করুন!
বীরশ্রেষ্ঠ নিয়েও চলেছে প্রতিশ্রুতিভঙ্গের খেলা
তর্পন


ভাস্কর চৌধুরীর লেখাটি পড়ে জগৎজ্যোতির সম্মন্ধে জানতে আগ্রহী হয়ে উঠি। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল যে আমাদের বীরশ্রেষ্ঠ উপাধী থেকে প্রতিশ্রুতিভঙ্গ শুরু। স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচারিত প্রতিশ্রুতিতে এই মুক্তিযোদ্ধাকে বীর শ্রেষ্ঠ ঘোষণার কথা বার বার বলা হলেও মাত্র কয়েক মাস পরে '৭২ এর ৬ এপ্রিল প্রথম গেজেটে একমাত্র বীরশ্রেষ্ঠ উপাধী পায় মুন্সী আবদুর রউফ । বলাবাহুল্য ৩ জনকে বীরউত্তম, ১৪ জনকে বীরবিক্রম এবং ২৫ জনকে বীরপ্রতীক হিসেবে ঘোষণা দেয়া হলেও জগৎজ্যোতির দুরের কথা কোন গণ মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধা এতে ছিল না । কেন? তবে কী এখানে অলিখিত বিধান ছিল যে জগৎজ্যোতির মত গণবাহিনীর সংশপ্তক যোদ্ধারা যতই বীরত্ব প্রদর্শণ করুক তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় উপাধী প্রযোজ্য নয়? পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালের ৬ ডিসেম্বর ৬ জন বীরশ্রেষ্ঠের নাম যুক্ত হয়। দেখা যায় জিয়া সহ সর্বমোট ৬৮ জন বীরউত্তম খেতাব পায় । কাদের সিদ্দিকী সহ মাত্র ২ জন আসে গণবাহিনী থেকে! (সুত্র: বীরশ্রেষ্ঠ , বীরউত্তমবীরবিক্রম , এবং বীরপ্রতীক দের তালিকা)।

জগৎজ্যোতি কে বীরশ্রেষ্ট উপাধি দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগঠক বেলাল মোহাম্মদ জানান, শহীদ জগৎজ্যোতিকে বীরশ্রেষ্ট খেতাব দেওয়ার ঘোষনা দেওয়া হয়েছিল একাধিকবার এবং তার বীরত্বগাথা প্রচার হচ্ছিল সম্মানের সঙ্গে। জাতির অস্তিত্ব রক্ষার এই যুদ্ধে জগৎজ্যোতির প্রত্যুতপন্নমতিত্ব, প্রাকৃতিকভাবে যোগাযোগ বিচ্ছন্ন দায়িত্বরত এলাকায় নতুন নতুন রণকৌশল ও দুঃসাহসী সফল অপারেশনের কারণে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে একাধিকবার তার বীরত্বগাঁথা প্রচার হচ্ছিল সম্মানের সঙ্গে। আর একারণে তার প্রতি চরম ক্ষুদ্ধ ছিল পাক হায়েনারা।

জগৎজ্যোতি দাস বীরবিক্রম
’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ভাটি বাংলার গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাস। বাবা মা আদর করে ডাকতেন শ্যাম নামে। যদিও কোন কোন তথ্যে সে কোন উপাধি পায় নি কিন্তু বীর বিক্রমদের তালিকা অনুযায়ী সেক্টর ৫ থেকে তাকে বীরবিক্রম উপাধী দেয়া হয় ।

কমিউনিষ্ট আদর্শে দিক্ষিত হলেন
হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামের জীতেন্দ্র দাসের কনিষ্ঠ পুত্র জগৎজ্যোতি। শৈশব থেকে জ্যোতি শান্ত স্বভাবে হলেও ছিলেন প্রতিবাদী, জেদি, মেধাবী ও সাহসী । স্কুল জীবনেই জ্যোতি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৬৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর সুনামগঞ্জ কলেজে ভর্তি হয়ে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন এবং তেজোদীপ্ত, বিপ্লবী ও স্পষ্টভাষী ছাত্র নেতা হিসেবে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন । ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে বিশেষ দায়িত্ব পালনে ভারতের গৌহাটির নওপং কলেজে ভর্তি হন। সেখানে অবস্থানকালে অনেকগুলো অঞ্চলের ভাষা আয়ত্ব করেন এবং ধীরে ধীরে নকশাল পন্থীদের সঙ্গে জড়িত হন। এখানে অস্ত্র গোলাবারুদ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারনা নিয়ে আবার দেশে ফিরে আসেন।

যুদ্ধ শুরু হলো
’৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে যখন সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয় । পাকবাহিনীর বর্বরোচিত হামলা ও নৃশংস হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে রূখে দাড়ানোর জন্য সিদ্ধান্ত নেন জগৎজ্যোতি । যোগ দেন ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ইকো-১ ট্রেনিং ক্যাম্পে। বাংলার ভাটি অঞ্চলের সুনামগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোনা এবং হবিগঞ্জের হাওরাঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের ৭ নং সেক্টর। এ সেক্টরের কমান্ডারের দায়্ত্বি পান তৎকালীন মেজর শওকত আলী। ৭ নং সেক্টরকে কয়েকটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। এর মধ্যে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের দায়্ত্বি দেওয়া হয় বর্তমান বিশিষ্ট নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে। তার অধীনেই প্রথমত জগৎজ্যোতি বিভিন্ন আক্রমণে অংশগ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে প্রশিক্ষিত চৌকস যোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত হয় গেরিলা দল, যার নাম দেওয়া হয় ফায়ারিং স্ট্কোয়াড ‘দাস পার্টি’।

কয়েকটি সফল অপারেশন
জগৎজ্যোতি ইংরেজি, হিন্দি, গৌহাটির আঞ্চলিক ভাষায় পারদর্শী হওয়ার সুবাদে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সঙ্গে তার যোগাযোগ সহজতর হয় । এর ফলে দাস পার্টির জন্য ভারতীয় মিত্র বাহিনীর জগৎজ্যোতি আধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহে সমর্থ হন । দাস পার্টির উল্লেখযোগ্য একটি অপারেশন ছিল পাকবাহিনীর বার্জ আক্রমণ । ’৭১-এর ১৬ অক্টোবর পাকবাহিনীর সেই বার্জটিতে আক্রমণ চালিয়ে বার্জটি নিমজ্জিত করে। দাস বাহিনীর গেরিলা অভিযানের মাধ্যমে পাকিস্তানী শত্রু ঘাঁটি ধ্বংস শুরু করে। পরবর্তীতে পাহাড়পুর অপারেশন, বানিয়াচংয়ে কার্গো বিধ্বস্ত করা, বানিয়াচং থানা অপারেশনসহ বেশ ক’টি ছোট বড় অপারেশন দাস পার্টির যোদ্ধারা সফল ভাবে সম্পন্ন করে।

বদলপুর অপারেশন
বদলপুর অপারেশন ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি একটি বিশাল সাফল্য । জগৎজ্যোতির সঙ্গে ছিল বানিয়াচংয়ের মোহাম্মদ আলী মমিন, আমির হোসেন, খালেক মাস্টার, হায়দারুজ্জামান খান ধন মিয়া, আজমিরীগঞ্জের রাশিদুল হাসান চৌধুরী কাজল, মতিউর রহমান, নিত্যানন্দ দাস, ইলিয়াছ চৌধুরী, আঃ রশীদ, নিপেন্দ্র দাশ, ছাতকের আয়ুব আলী, আঃ মজিদ ও দিরাই উপজেলার আহবাব হোসেন এবং নীলু। জগৎজ্যোতির দল আজিমিরীগঞ্জ, মারকুলি, গুঙ্গিয়ারগাঁও প্রভৃতি অঞ্চলে শত্রু ঘাঁটি ধ্বংস করে দেয়। বদলপুরে শত্রুসেনারা দাস পার্টির প্রতিরোধের মুখে পাকসেনারা শক্তি বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়। গুলি ছোড়ার জন্য হেলিকপ্টারও ব্যবহার করা হয় । রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জগৎজ্যোতি র পাশে ছিল ইলিয়াস নামে আরেকজন অসীম সাহসী যোদ্ধা।

শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত লড়ে গেলেন
পাক ক্যাম্প থেকে মাত্র ২০০ গজ দুরে রাজাকার/পাক সেনাদের আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে দাস পার্টি। রণাঙ্গণে পরিস্হিতির ভয়াবহ চিন্তা করে এক পর্যায়ে জ্যোতি তার দলকে ফিরে যাবার নির্দেশ দিয়ে একটি মাত্র এলএমজি নিয়ে নিজে একাই যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন । এজন্য জ্যোতি সহযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী মমিনকে নির্দেশ দেন যাতে অন্যরা তাদের জীবন বাঁচিয়ে নিরাপদ স্হানে সরে যায় । এরপর দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন মাত্র দুইজন, জ্যোতি ও ইলিয়াছ। সুস্হির এবং দৃঢ় মনোবলের সঙ্গে তারা যুদ্ধ করতে থাকে একটানা কিন্তু হঠাৎ ইলিছাস পাঁজরে গুলিবিদ্ধ হন। জ্যোতি পিছু না হটে তার মাথার লাল পাগড়ি খুলে শক্ত করে ইলিয়াসের বুকে‌ এবং পিঠে বেঁধে দেয়, যাতে তার রক্তক্ষরণ থেকে যায়। ইলিয়াছ সেই অবস্হায় মেশিনগান নিয়ে ক্রমাগত গুলি ছুড়তে থাকে পাক হানাদারদের ওপর।

অবিশ্বাস্য হলেও তিন দিক থেকে আক্রমণ সত্ত্বেও দক্ষ যোদ্ধা জ্যোতির কাছে ভিড়তে পারেনি পাকসেনারা। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ম্যাগজিন লোড করে শত্রুর অবস্থান দেখতে মাথা উঁচু করতে মুহুর্তে ১টি গুলি জগৎজ্যোতির চোখে বিদ্ধ করে( একটু সুত্র দাবী করে তার পাঁজর বিদ্ধ করে)। মেশিনগান হাতে উপুড় হয়ে পাশের বিলের পানিতে নিশ্চল হয়ে ঢলে পড়েন জ্যোতি ।

জনসমক্ষে ঝুলিয়ে রাখা হলো
রাজাকারেরা রাতে জ্যোতির মৃতদেহ (একটি সুত্রে বলা হয় তিনি তখনও বেঁচে ছিলেন) খুজে পেয়ে পাকবাহিনীকে খবর দেয় । তাকে আজমিরীগঞ্জ বাজারে নিয়ে যায়। রাজাকাররা জ্যোতি হত্যার ঘটনা ছড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য তার দেহ কে আজমিরীগঞ্জ গরুর হাটে একটি খুঁটির সঙ্গে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। তারপর চলে মৃতদেহ অবমাননা । একটি সুত্র দাবী করে জ্যোতি তখনও জীবিত ছিল এবং তাকে অমানুষিক নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয় । হাফপ্যান্ট ও গেঞ্জি পরা জ্যোতির নিথর দেহটি কোন সৎকার ছাড়া ঝুলিয়ে রেখে পরে একসময় ভাসিয়ে দেওয়া হয় কুশিয়ারা নদীতে। কিন্ত্ত তার সহযোদ্ধারা তার মৃত্যুতে পিছু হটেনি । জগৎজ্যোতি ছিল তাদের কাছে জীবনের বিনিময়ে দেশের জন্য যুদ্ধ করার এক অনন্য দৃষ্টান্ত । জগৎজ্যোতির বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের কাহিনী সিলেটের সেই অঞ্চলের মানুষের কাছে এখনে মুখে মুখে ফেরে ।

বিস্মৃতির অতলে জগৎজ্যোতি
ছিটে ফোটা দু একটি লেখা ছাড়া খুব কমই আলোচনায় এসেছে এই মহান বীর । মইদুল হাসানের "মূলধারা একাত্তরে" পড়েছিলাম আওয়ামীলীগের একটি অংশ ছাত্রইউনিয়ন সহ দলের বাইরের কোন মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতির পক্ষে ছিল না ।

জগৎজ্যোতির কমান্ডার সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দেশের ক্ষমতাশীল দলের কান্ডারীদের একজন হয়ে তার ভাগ্য বদলেছেন । চ্যানেল আইতে তৃতীয় মাত্রা সহ একাধিক টিভি অনুষ্ঠানে তাকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে দেখেছি ।কিন্তু এই যোদ্ধার নাম ভুলেও বলতে দেখিনি । হয়তো পুরনো কাহিনী বলে সবাই ভুলে গেছে ।


সূত্র:

ক. ভাটিবাংলায় মুক্তিযুদ্ধ এবং দাস পার্টি , রাশেদ আহমেদ খান, দৈনিক সমকাল, ৮ ডিসেম্বর ২০০৬।
খ. মুক্তিযুদ্ধে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের শহীদ তিন ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতিদাস, তালেব ও গিয়াস

Monday, April 6, 2009

ইমন জুবায়ের ; একটি হত্যাকান্ডের পটভূমি

ইমন জুবায়ের

একটি হত্যাকান্ডের পটভূমি


এই আধুনিক সময়েও মধ্যযুগীয় পুরনো শাস্ত্র আর তার রচয়িতাদের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না; বললে- মৃত্যু অনিবার্য। তেমনি একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল ২০০৪ সালে। হল্যান্ডে। মরক্কোর এক ধর্মান্ধ জঙ্গি নির্মম ভাবে খুন করে বসল নেদারল্যান্ডের একজন মুক্তমনা চলচ্চিত্র নির্মাতাকে। আবারও প্রকাশ পেল ধর্মান্ধতার বিভৎস রুপ। চমকে উঠল সমগ্র পশ্চিমাবিশ্ব। সমগ্র পশ্চিমাবিশ্ব আবারও পরম অবিশ্বাসের চোখে মুসলিমবিশ্বের দিকে তাকাল- যা ভবিষ্যৎ সর্ম্পকের ক্ষেত্রে শুভ পরিনতি বয়ে আনবে না বলেই মনে হল ...

সোমালিয় নারী আইয়ান হিরসি আলীর জন্ম ১৩ নভেম্বর ১৯৬৯ সালে সোমালিয়ার রাজধানী মোগাডিসুতে। আইয়ান হিরসি আলীর বাবা হিরসি মাগান ইসে ছিলেন রাজনীতিবিদ ও পন্ডিত। মাত্র ৫ বছর বয়েসে আইয়ান হিরসি আলীকে ‘খৎনা’-র ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মূখীন হতে হয়। নারীর খৎনাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় Clitorectomyবলা হয়। অহেতুক যন্ত্রণাদায়ক এই ঘৃন্য প্রথাটি আফ্রিকাসহ আরববিশ্বের অনেক নারীর জীবনকে করে তোলে বিষময়। হিরসি মাগান ইসে-র অবশ্য তাঁর মেয়ের Clitorectomy করার ব্যাপারে অমত ছিল। তবে তিনি তখন জেলে ছিলেন বলে তিনি ঐ ‘অপকর্মে’ বাধা দিতে পারেননি।
আইয়ান হিরসি আলীর ৮ বছর বয়েসে তার পরিবার চলে আসে সৌদি আরব; সেখান থেকে ইথিওপিয়া। পরে পরিবারটি সেটল করে কেনিয়ায়। নাইরোবির মুসলিম গালর্স সেকেন্ডারি স্কুলে ভর্তি হয়ে ইংরেজি শেখে আইয়ান হিরসি আলী। তবে, মেয়েবেলা থেকেই ইসলাম ধর্মে শিক্ষা হয়েছিল। পড়তে হত কোরান।
কেনিয়ার শিক্ষাব্যবস্থায় প্রচুর অর্থ ঢালে সৌদি আরব । ফলে, আইয়ান হিরসি আলী কট্টর ওয়াহাবী শিক্ষা পেয়েছিল। স্কুলের ইউনিফর্মের সঙ্গে পরতে হত হিজাব । ওয়াহাবী শিক্ষার তুলনায় সোমালিয়া ও কেনিয়ার ইসলাম ছিল অনেকটা সহনশীল হলেও ওয়াহাবীপন্থি শিক্ষকদের প্ররোচনায় মিশরের কুখ্যাত জঙ্গি সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠে আইয়ান হিরসি আলী । মুসলিম আলেমরা ব্রিটিশ লেখক সালমান রুশদীর বিরুদ্ধে ফতোয়া দিলে আইয়ান হিরসি আলী সমর্থন জানায়।
মেয়েবেলা থেকেই বই পড়তে ভালো লাগত আইয়ান হিরসি আলীর। কেনিয়ায় থাকাকালে প্রচুর ধর্মনিরপেক্ষ বই পড়ার সুযোগ হল। এভাবে মনের গড়ন বদলে যাচ্ছিল মেয়েটির।
কিছু সংশয় তৈরি হচ্ছিল।



১৯৯২ সাল। আইয়ান হিরসি আলীর বাবা তার মেয়ের বিয়ে ঠিক করে। ‘আগন্তুক দ্বারা ধর্ষিতা হব না’-এই শপথ নিয়ে আইয়ান হিরসি আলী বিদেশ পাড়ি জমাবে ভাবল। পলিটিকাল অ্যাসাইলামের অজুহাতে কাগজপত্র সেভাবেই তৈরি করল-করে নেদারল্যান্ডে পৌঁছল। যা হোক, হল্যান্ডে বসবাসের অনুমতি পেল। আমসট্রাডাম শহর। কাজ খুঁজল। অড জব। পেল। ডাচ ভাষা শিখল। ডাচদের সমাজ দেখে মুগ্ধ আইয়ান হিরসি আলী-বিশেষ করে নারীস্বাধীনতার বিষয়টি। সময় পেলেই বই পড়ত। এই প্রথম ফ্রয়েড পড়ে বিস্মিত হল। ধর্ম ব্যতীত যে নৈতিকতা সম্ভব- তা জেনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়বে বলে ঠিক করল। ভর্তি হল লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ।
২০০০ অবধি চলল পড়াশোনা।



রাস্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ পাস করে আইয়ান হিরসি আলী রাজনীতি করবেন ভাবলেন। যোগ দিলেন একটি মধ্য-বাম শ্রমিক দলে। পড়াশোনা চলছিল। ইসলাধর্মে আর বিশ্বাস ধরে রাখা যাচ্ছিল না। ৯/১১ পর তার ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে বিব্রত বোধ করলেন। লাইডেন অধ্যাপক দার্শনিক হেরমান ফিলিপস ‘দি অ্যাথেইস্ট ম্যানিফেস্টো’ নামে একটি ক্ষুদ্র বই লিখেছিলেন। বইটি পড়ে পুরোপুরি অবিশ্বাসী হয়ে গেলেন আইয়ান হিরসি আলী। ২০০২ সালে ইসলাম ত্যাগ করে নিজেকে অ্যাথেইস্ট ভাবতে শুরু করলেন। ইসলামের সমালোচনা করে নিবন্ধ লেখতে শুরু করলেন। সমকাম ও পরকীয়ার ইসলামের ধ্বজাধারীরা যে শাস্তি দেয়-তার কট্টর সমালোচনা করলেন। লিখলেন: ‘৯/১১ এর খুনিদের আর আমার ঈশ্বর এক হতে পারে না।’ ইসলামকে বললেন, পিছিয়ে পড়া ধর্ম-যা কি না গনতন্ত্রের সঙ্গে কমপাটিবল না। তাঁর মতে, ইসলাম হল নয়া ফ্যাসীবাদ। খিলাফত চলে শরিয়া আইনে। যেখানে বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হলে পাথর ছুঁড়ে মারা হয়, সমকামীদের মারা হয় বেত -আর অবিশ্বাসীদের করা হয় হত্যা । ইসলাম নাৎসীবাদ না তো কী! আইয়ান হিরসি আলী মেয়েদের Clitorectomy বিরোধী। তাঁর মতে, Clitorectomy যৌনআকাঙ্খা দূর তো করেই না-উপরোন্ত তা হয়ে দাঁড়ায় যন্ত্রণাদায়ক। Clitorectomy করা মেয়েরা জীবনভর যন্ত্রণা সহ্য করে ।
এসব নিয়েই “দি সন ফ্যাক্টরি” নামে বই লিখলেন আইয়ান হিরসি আলী ।
বিপদ ঘনিয়ে এল।
হল্যান্ডের একটি (মুসলিম) জঙ্গি সংগঠনের নাম:হোফসটাড নেটওয়ার্ক। হল্যান্ডে প্রায় ১০ লক্ষ মুসলিম বাস করে। হোফসটাড নেটওয়ার্ক মুসলিম ডাচদের একটি মৌলবাদী যুব সংগঠন। দীর্ঘকাল ধরেই তারা ইউরোপে তাদের (অপ) তৎপরতা চালিয়ে আসছিল। স্পেন ও বেলজিয়ামেও নাকি এদের শাখা আছে। মিশরীয় মুসলিম সংগঠন, ‘তাকফির ওয়াল হিজরার’ আদর্শে হোফসটাড নেটওয়ার্ক-এর সদস্যরা অনুপ্রাণিত।
হোফসটাড নেটওয়ার্ক-এর কাছ থেকেই প্রথম মৃত্যুর হুমকি পেলেন আইয়ান হিরসি আলী। তবে, ঘাবড়ালেন না। লেখা চালিয়ে গেলেন। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তকের কঠোর সমালোচনা করে লিখলেন; ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বিকৃতরুচির একজন pedophileছিলেন। pedophile শব্দের অর্থ: An adult who is sexually attracted to children! ৫২ বছর বয়েসে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা ৬ বছরের শিশু আয়েশাকে বিবাহ করেন। আর, বালিকা আয়েশার ৯ বছর বয়েস যৌনমিলন হয়!
হোফসটাড নেটওয়ার্ক-এর সদস্যরা ক্রদ্ধ হয়ে উঠতে থাকে।
ঠিক এই সময়েই থিও ভ্যান গগ-এর সঙ্গে পরিচয় হল তাঁর।


থিও ভ্যান গগ। ওলন্দাজ (ডাচ) চিত্রপরিচালক, প্রয়োজক, কলামিষ্ট, লেখক ও অভিনেতা। বিখ্যাত চিত্রকর ভ্যান গগ এঁরই উর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ। আইয়ান হিরসি আলীর লেখা পড়ে চমৎকৃত হয়েছিলেন থিও ভ্যান গগ। তিনি নিজেও শাস্ত্রবিরোধী। আইয়ান হিরসি আলীর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একটি ছবি নির্মান করবেন ভাবলেন। আইয়ান হিরসি আলীই চিত্রনাট্য লিখলেন। মাত্র ১০ মিনিটের ছবি। তাতেই যা বলার বলা গেল। থিও ভ্যান গগ নিজেই স্বল্পদৈর্ঘ্যরে চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা ও পরিচালনা করলেন। নাম রাখলেন: ‘সাবমিশন।’ থিও ভ্যান গগ তখনও জানতেন না ঘনিয়ে আসছে মৃত্যু। ইসলাম নারীদের কী চোখে দেখে ১০ মিনিটের ছবিতে সে কথাই উঠে এসেছে। দুটো কথা বড় বিপদজনক। (১) অবাধ্য হলে মেয়েদের মারধোর করা যাবে। (২) রাজী না হলে-তারপর যা হবে-তা ধর্ষনেরই শামিল!
মূলত; আত্মসমর্পন আল্লার প্রতি মানুষের নয়-পুরুষের প্রতি নারীর!



‘সাবমিশন’ ছবিটি রিলিজ পায় ২৯ আগস্ট ২০০৪। (আমি সরাসরি ছবিটার লিঙ্ক দিলাম না। Submission লিখে গুগল সার্চ করলে আশা করি ইউ টিউবে ১০ মিনিটের ছবিটি পেয়ে যাবেন। ) ছবিটি রিলিজ পাওয়ার পর হল্যান্ডের মুসলিম কমিউনিটিতে প্রচন্ড বিক্ষোভ দেখা যায়। হোফসটাড নেটওয়ার্কসহ ইউরোপের ইসলামী মৌলবাদী সংগঠনগুলি ফেটে পড়ে তীব্র আক্রোশে। অর্ধনগ্ন অভিনেত্রীর শরীরের পবিত্র কোরানের আয়াত! মোহাম্মদ বোওয়েরি। ২৬ বছর বয়েসি মরক্কোর যুবক; ডাচ নাগরিক। হোফসটাড নেটওয়ার্কের সদস্য। সিদ্ধান্ত নিল-সে থিও ভ্যান গগ এবং আইয়ান হিরসি আলীকে খুন করবে!
আমসট্রাডাম। ২০০৪। নভেম্বর মাসের ২ তারিখ; সকাল। থিও ভ্যান গগ সাইকেল করে যাচ্ছিলেন কাজে। মোহাম্মদ বোওয়েরি কাছ থেকে এইচ এস ২০০০ হ্যান্ডগান দিয়ে আটবার গুলি করে। তক্ষনাৎ মৃত্যু হয় থিও ভ্যান গগ এর। মোহাম্মদ বোওয়েরি তারপর ধারালো ছুড়ি বের করে থিও ভ্যান গগ এর গলা কেটে ফেলে। বুকে তীক্ষ্ম ছোরা দিয়ে ষ্ট্যাব করে। বুকের ওপর মিশরী সংগঠন তাকফির ওয়াল হিজরার রেফারেন্সসমেত একটা নোট গেঁথে দেয়। নোটে পশ্চিমা সরকার ইহুদিবাদ ও আইয়ান হিরসি আলীর ধ্বংস কামনা করা হয়।
পালানোর সময় পুলিশ মোহাম্মদ বোওয়েরি পায়ে গুলি করে।
সে ধরা পড়ে।
তার বিচার হয়।
সে এখন যাবৎজ্জীবন কারাদন্ড ভোগ করছে।
থিও ভ্যান গগ-এর মৃত্যুর পর আইয়ান হিরসি আলী মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়লেও নিজের বিশ্বাস থেকে বিন্দুমাত্র টলে যাননি। নিহত থিও ভ্যান গগ-এর মা পুত্রশোক কাটিয়ে উঠে বললেন: আমি আমার ছেলের আদর্শে বিশ্বাস করি।
বর্তমানে ডাচ সরকারের তত্ত্বাবধানে আইয়ান হিরসি আলী লোকচক্ষুর অন্তরালে আছেন।
এই জন্যই বলছিলাম, এই আধুনিক সময়েও পুরনো শাস্ত্রের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না। বললে মৃত্যু অনিবার্য।



অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাতের সাম্প্রতিক এক গবেষনায় জানা গেছে বাংলাদেশে বছরে দশ (১০) লক্ষ করে ধর্মান্ধ জঙ্গি বাড়ছে! এদের অর্থায়নের যে টাকা লগ্নি করা হয়েছে তার টার্নওভারের পরিমান দেড় হাজার কোটি টাকার মতন!
হয়তো, থিও ভ্যান গগ এবং আইয়ান হিরসি আলী ‘সাবমিশন’ নির্মান করে বাড়াবাড়ি করেছেন। কিন্তু, একবার ভেবে দেখুন- আমরা টিভিতে রোজ যে নাটক/চলচ্চিত্র দেখছি-যা আমাদের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি- সেসবও তো বাংলাদেশি জঙ্গিদের সহ্য হওয়ার কথা না। তার ওপর জঙ্গিদের পিছনে রয়েছে অঢেল অর্থ।
কার্যত, আমরা কেউই নিরাপদ নই।

উৎস:

http://en.wikipedia.org/wiki/Submission_(film)

http://en.wikipedia.org/wiki/Ayaan_Hirsi_Ali

Click This Link)



রোজনামচা বলেছেন:

শয়তানের আওয়াজ বলে সঙ্গীতকে এরা
হারাম করতে চায়-
আমি তাতে দুঃখ পাই।
এবং
‘মধ্যযুগের আফিম’ বলে ধর্ম-কথাকে ওরা
নিষিদ্ধ করতে চায়,
আমি তাতে ক্ষুদ্ধ হই।

দিন রাত মাইকে মাইকে সারা শহরে
গানের যে ঝালাপালা,
ত্যক্ত হয়ে লোকেরাই একদিন গানকে
‘হারাম’ করার ব্যবস্থা করবে,
তাতে এদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে-
কিন্তু আমি দুঃখ পাব।

এবং
দিন রাত মাইকে মাইকে সারা শহরে
ধর্ম কথার যে হাঁক-ডাক,
তিক্ত হয়ে লোকেরাই একদিন,
ধর্ম-কথাকে নিষিদ্ধ করবে,
তাতে ওদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে-
কিন্তু আমি ক্ষুদ্ধ হব।



আপনার পোস্টটা পড়ে আবারো দু:খ পেলাম, ক্ষুদ্ধ হলাম। ধন্যবাদ আপনাকে।
ইসলামের নাম করে যে নির্যাতন আইয়ান হিরসি আলীদের ওপর হচ্ছে তা তাদের জীবনকে অসহনীয় করে তুলছে। এসব আমাকে ক্ষুদ্ধ করে। কিন্তু যখন দেখি আলী'রাও উল্টো ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে সামষ্টিকতাকে মোটাদাগে আক্রমন করে অন্ধের মত তখন দু:খ পাই।

অতএব-
লক্ষন যা, তাতে দুঃখ আর ক্ষোভই
আমার কপালের লেখা।